আহমদ রফিক: বাংলাদেশি সমাজের অবস্থা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগজনিত কটি খবর আমাদের জন্য বিব্রতকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘অভ্যন্তরীণ সমস্যা’ বলে সেগুলো উড়িয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। উপলক্ষ যদিও বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা, কিন্তু সেই সঙ্গে উঠে এসেছে ‘সুশাসন ও মানবাধিকার’ প্রতিষ্ঠার দিকগুলো প্রধান বিষয় হিসেবে। কিছুদিন আগে জাতিসংঘের স্থানীয় প্রতিনিধিসহ যুক্তরাজ্য ও জার্মানি বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিচারে উদ্বেগ প্রকাশ করে অনুরূপ দাবি জানায়। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ক্ষুব্ধ হয়ে জাতিসংঘ প্রতিনিধিকে ডেকে পাঠায় প্রতিবাদ জানাতে। এবার ‘সুশাসন ও মানবাধিকারে উন্নতির তাগিদ ইইউর।’ শিরোনামটি আপাত-নিরীহ হলেও এর তাৎপর্য যতটা নৈতিক ও আদর্শিক মূল্যবোধ-সংক্রান্ত, তার চেয়ে বেশি অর্থনৈতিক, সামাজিক-রাজনৈতিক। কথিত উদ্বেগ প্রকাশের সূত্র উৎস বাংলাদেশের জন্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে বাজার সুবিধাপ্রাপ্তি। তাদের ভাষ্য মতে, ‘ইউরোপের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কের ভিত্তিমূল হবে মানবাধিকার।’
বক্তব্যটি আরও স্পষ্ট করা হয়েছে এভাবে: ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা অব্যাহত রাখতে হলে গণতন্ত্র, সুশাসন, শ্রম-অধিকার, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলোতে বাংলাদেশকে আরও উন্নতি করতে হবে। এ বিষয়গুলোতে উন্নতির জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাশাপাশি জোটের সদস্য ২৭টি দেশের সঙ্গেও বাংলাদেশকে আগামী দুই বছর আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।’ বাণিজ্যের সঙ্গে ‘সুশাসন ও মানবাধিকারের’ সম্পর্ক বাংলাদেশের কাছে উদ্ভট মনে হতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাদের সব দেশে কি মানবাধিকার যথাযথভাবে পালিত হয়ে থাকে? কিন্তু বাংলাদেশ যেহেতু আর্থরাজনৈতিক বিচারে সুবিধাভোগী দেশ, তাই এমন প্রশ্ন করার সুযোগ ও অধিকার তাদের কতটা আছে, তা আমাদের জানা নেই। তবে বাংলাদেশ তাদের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে বারবারই সন্ত্রাস দমনে জিরো টলারেন্সের কথা উল্লেখ করে আসছে। কিন্তু মৌলবাদ ও সন্ত্রাস দমন এবং অভ্যন্তরীণ সামাজিক নৈরাজ্য, দুর্নীতি, গুম, খুন ও ভিন্ন মতে অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে যথার্থ ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। এটা নেহাত বাণিজ্যিক সুবিধা লাভের একমাত্র বিষয় নয়। এ দাবি দেশের গণতন্ত্রকামী, সুশাসনকামী মানুষেরও। যে ক্ষেত্রে বারবার জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থার কথা বলা হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং ভিন্ন মতপ্রকাশের নিরাপত্তার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত। এদিকে যে বাংলাদেশের সামাজিক অঙ্গনে, বিশেষ করে শিক্ষায়তনেও ঘাটতি রয়েছে, তা অস্বীকারের উপায় নেই। সাম্প্রতিক আবরার হত্যার ঘটনা তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। একদিকে যখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চলছে নিজ দলের সহযোগী সংগঠন, বিশেষ করে যুবলীগের বিরুদ্ধে, সে সময় বুয়েটের মতো কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্নমতের জন্য ছাত্রলীগের নির্যাতনে আবরার হত্যাকান্ড শাসকদের জিরো টলারেন্স অভিযান প্রশ্নের মুখে পড়তে বাধ্য। এসব ঘটনা যেমন বাংলাদেশের নাগরিকদের নিরাপত্তাহীনতার চিন্তায় ফেলছে অভ্যন্তরীণ ঘটনা হিসেবেই, তেমনি উদ্বেগ বাড়াচ্ছে শক্তিমান বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর। তারই পরিণাম হিসেবে উদ্বেগ কখনো জাতিসংঘ, কখনো ইইউর মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনের এবং তা নীতিনৈতিকতার সীমানা ছাড়িয়ে বাণিজ্যিক রাজনৈতিক ভুবনে প্রবেশ করছে।
আমরা যদি বৈদেশিক বিষয়টিকে আমলে না-ও আনি, তবু স্বদেশে সমাজ ও রাজনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির সুস্থ পরিবেশের তাগিদে, মানুষের জীবনের নিরাপত্তার প্রয়োজনেও উল্লিখিত বিষয়গুলোর গুরুত্ব অস্বীকার করতে পারি না। এতদিনকার দুর্নীতি, অনাচার ও নৈরাজ্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে, দেরিতে হলেও গুরুত্ব পেয়েছে বলে তার ঘোষণা, অভিযান চলছে, চলবে। যেমন বলেছেন অভিযানের শুরুতে, এখনো সেই একই ঘোষণা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাজনৈতিক কর্ম তাগিদের সুবাদে যাতায়াতের কারণে শক্তিমান রাষ্ট্রগুলোর মনোভাব হয়তো আগেই বুঝতে পেরেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তাই দ্রুত প্রতিকার ব্যবস্থা শুরু। কিন্তু যে রাজনীতির একাংশে বিশেষ করে যুবলীগ-ছাত্রলীগে অনাচারের ও দুর্নীতির ক্ষত ব্যাপক, তা সারানোর কাজটি বেশ কঠিন। তাকে দৃঢ়তার সঙ্গে সেই কঠিনের মোকাবিলা করতে হবে। না হলে তার উদ্দেশ্য সফল ও লক্ষ্য অর্জিত হবে না।
অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য যাই হোক, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তার নিজ দলের সহযোগী সংগঠনের বিরুদ্ধে, সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে যুবলীগের বিরুদ্ধে যে অভিযান শুরু, তা নিয়ে সমাজের সর্বত্র ব্যাপক আলোচনা, সন্তোষ, সংশয় দুই-ই সেখানে কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী অভিযানের শুরুতে আরও বলেছিলেন, এরপর ছাত্রলীগ। অর্থাৎ শুদ্ধি অভিযানে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। অন্যরা মুখর না হলেও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একই সুরে কথা বলেছেন।
মানুষ আশা করে আছে, এবার বাস্তবিক একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে, যদিও এর মধ্যে ছাত্রলীগের দুর্বৃত্ত অংশ বুয়েটে আবরার হত্যাকান্ড ঘটিয়ে প্রধানমন্ত্রীর জন্য সমস্যা তৈরি করে ফেলেছে। স্বভাবতই তাকে আবারও দৃঢ়কণ্ঠে বলতে হয়েছে ‘কীসের ছাত্রলীগ! অপরাধী কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ দ্রুত গ্রেপ্তার ছাত্রনামধারী ১৩ জন দুর্বৃত্ত, কেউ রিমান্ডে, কেউ কারাগারে অপেক্ষমাণ। এ ঘটনা থেকে, বুয়েটসহ অন্যান্য বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রতিবাদী আন্দোলন থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট, ছাত্ররাজনীতির একটি অংশ দূষিত। এতটা দূষিত যে, তার দেহে পচন ধরেছে, ওষুধে-মলমে কাজ হবে না। দরকার হবে সার্জারির। অর্থাৎ পূর্বপরিচালিত সর্বাত্মক শুদ্ধি অভিযানের।
ঘটনা শুধু একটি-দুটি নয়। ইতিমধ্যে আরও কিছু আলামত প্রকাশ পাচ্ছে। বেশ কিছু চাঁদাবাজির ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশ পেয়েছে। একটি দৈনিকের উপ-সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে ‘ক্যাসিনো-কা-ে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসছে।’ এর আগেও একাধিকজনের লেখায় দেখা গেছে অনুরূপ মন্তব্য। তাদের মতে, এমন কা- রাজনীতির নেতাবিশেষের ‘আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া ঘটতে পারে না। আটক ও রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ তেমন আভাস-ইঙ্গিত মিলছে। একপর্যায়ে সম্রাটের উক্তিÑ‘আমাকে একা আটক করা কেন?’ আবার এমনও তথ্য বড় ভাইদের নিয়মিত টাকা বরাদ্দের। অনেক দুর্নীতির গুমোর ফাঁস হচ্ছে। ক্যাসিনো-কান্ডে পুলিশও জড়িত, এমন তথ্যও প্রকাশ পেয়েছে। এ ঘটনা সমাজের জন্য বিপজ্জনক। স্বভাবতই পুলিশ অন্তত ক্যাসিনো-কান্ডের বিপুল পরিমাণ আর্থিক দুর্নীতি ও অর্থপাচার ইত্যাদি ব্যাপারে কতটা দৃঢ়তা ও সততার পরিচয় দেবে, তা নিয়ে সংগত সংশয় মানুষের। ইতিমধ্যেই ক্যাসিনো অভিযান একটু ঝিমিয়ে পড়ছে। তাই প্রধানমন্ত্রীর আবারও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ অভিযান নিয়ে। যে ঘোষিত লক্ষ্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শুদ্ধি অভিযান শুরু, তা তাদেরই সর্বাত্মক কার্যকারিতায় শেষ করতে হবে। শুধু ক্যাসিনো বা যুবলীগই নয়, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিতে লিপ্ত ছাত্রলীগকে কি ছাড় দিলে চলবে? চলবে ছাত্রাবাসে ছাত্রাবাসে তাদের অনাচার-নির্যাতন, অপরাজনীতি বন্ধ না হলে?
ছাত্রাবাসের ভেতরে-বাইরে সব অপকর্ম, দুর্বৃত্তপনা ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বন্ধ করার অভিযান শুরু না করলে সেটা বৃত্তের একাংশে অভিযানে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। দূষিত ছাত্ররাজনীতি তাতে শুদ্ধ হবে না। ক্ষমতাসীন দলের দু-একজনকে বলতে শোনা যাচ্ছে দু-এক বছরের জন্য ছাত্ররাজনীতি বন্ধ থাকুক। আমাদের বক্তব্য, শুধু উপসর্গের চিকিৎসা করলে, দৃশ্যমান ক্ষতে মলম লাগিয়ে আপাত চিকিৎসায় ব্যাধির অবসান ঘটবে না। এ পর্যন্ত যেসব ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে এবং পাচ্ছে, তাতে লক্ষ্য অর্জনে চিকিৎসা একটাই বিষঝাড় সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে সর্বাত্মক অভিযানের মাধ্যমে। তাতে বিক্ষিপ্ত শিকড়-বাকর অনুকূল পরিবেশে নতুন শক্তিতে গজিয়ে উঠতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার বাস্তবায়নে এর বাইরে বিকল্প কোনো পথ নেই। আমরা আশা করব, দূষণরোধ ও বিষাক্ত আগাছা পুরোপুরি নির্মূল না করে শুদ্ধি অভিযান যেন বন্ধ না হয়।